আজ শুক্রবার, ১৪ মার্চ, ২০২৫ || ২৯ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শুক্রবার, ০৪:০০ পূর্বাহ্ন
বৃহস্পতিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫   |   sonalisandwip.com
স্মরণ : ভাষা সৈনিক অধ্যাপক আসিফুল হক খান - ডা. এম ফারুক ইউ চৌধুরী

“আপ জুলমুল আমীন হ্যায়, নূরুল আমীন নেহী” [“আপনি জুলমুল আমীন (জুলুমে বিশ্বাসী), নূরুল আমীন (বিশ্বাসের আলো) নন]। “ - চোস্ত উর্দুতে আসিফুল হক খানের এই প্রতিবাদী ও ক্ষুব্ধ উচ্চারণ ছিল বায়ান্ন’র ২৩ ফেব্রুয়ারিতে স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ভাষা আন্দোলনের ‘কন্ট্রোলরুম’ থেকে ।

উল্লেখ্য, ২১ ফেব্রুয়ারির মর্মন্তুদ ঘটনার পর ২২ তারিখ থেকে স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ভাষা আন্দোলনের ‘কন্ট্রোলরুম’-এ পরিণত হয় এবং বাংলা ভাষার পক্ষে মাইকে একের পর এক জ্বালাময়ী বক্তব্য চলতে থাকে।

২৩ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দুভাষী ছাত্ররাও বাংলাভাষার সপক্ষে বক্তব্য দিতে চাইলে উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের এম এ আসিফুল হক খান তাঁদের উৎসাহিত করেন এবং নিজে চোস্ত উর্দুতে তাঁর জ্বালাময়ী বক্তৃতার এক পর্যায়ে পূর্ববাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীনকে ‘জুলমুল আমীন (জুলুমে বিশ্বাসী) আখ্যায়িত করেন। যার ভাবার্থ দাঁড়ায় -মুখ্যমন্ত্রী নামে ‘নূরুল আমীন’ হলেও কাজে ‘নূরুল আমীন’ (যার বাংলা অর্থ -‘বিশ্বাসের আলো’) নন, বরং ‘জুলুমে বিশ্বাসী’।

জানা যায়, অনতিদূরেই জগন্নাথ হলে তখন পূর্ববাংলা আইনসভার অধিবেশন চলছিল যেখানে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন উপস্থিত ছিলেন। টহলরত গোয়েন্দারা অন্যান্য ‘উর্দুভাষী অবাঙ্গালী’ বক্তার সাথে আসিফুল হক খানকেও ‘উর্দুভাষী অবাঙ্গালী’ হিসেবে বিবেচনা করেন এবং বিস্মিত হন যে, ‘উর্দুভাষী অবাঙ্গালী’ ছাত্ররাও ভাষা আন্দোলনে শামিল হয়েছেন।

২৪শে ফেব্রুয়ারীর ‘আজাদ’-এর নিজস্ব সংবাদ দাতার প্রতিবেদনে বলা হয়, “.........গতকল্য সকাল হইতে সলিমুল্লাহ হলে মাইকযোগে বক্তৃতা দেওয়া হয়। এই বক্তৃতায় উর্দুভাষী ছাত্ররাও অংশগ্রহণ করেন।“

দৈহিক গঠন, উচ্চতা ও গাত্রবর্ণে আসিফুল হক খানকে অবাঙ্গালী বলেই ভ্রম হতো। পরে গোয়েন্দারা জানতে পারেন যে, এ ‘উর্দুভাষী’ বক্তা অবাঙ্গালী নন, বরং বাঙ্গালী এবং তিনি সন্দ্বীপের। গোয়েন্দাদের একজন এসপি মহিউদ্দীন তৎক্ষণাৎ তাঁর সন্দ্বীপী সহকর্মী মুহম্মদ আমিনউল্ল্যাহকে খবর পাঠান।

বাংলা অন্তঃপ্রাণ চৌকশ গোয়েন্দা কর্মকর্তা মুহম্মদ আমিনউল্ল্যাহ দ্রুত এসে জিজ্ঞাসাবাদের ছলে আসিফুল হক খানকে সবার দৃষ্টির আড়ালে নিয়ে ছেড়ে দেন। এতেও শেষ রক্ষা হয়নি, আসিফুল হক খানের উপর হুলিয়া জারি হয়।

উল্লেখ্য, আসিফুল হক খান ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উর্দূ ভাষা ও সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করে কুষ্টিয়া কলেজে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন।

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারীতে সরকারী কলেজের চাকরীর জন্য পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)-এ ইন্টারভিউ দিতে কুষ্টিয়া থেকে তিনি ঢাকা আসেন এবং উঠেন তাঁর পূর্বতন আবাসস্থল স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে –যা তখন ভাষা আন্দোলনের অন্যতম পরিচালন কেন্দ্র। এখানে এসে তিনি আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন এবং ২১ ফেব্রুয়ারির মিছিলে অংশগ্রহন করেন।

২৩ ফেব্রুয়ারীর ঘটনায় জারিকৃত হুলিয়ার কারনে পুলিশের তাড়া খেয়ে তিনি যখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, আল্লাহর তরফ থেকে তখন তাঁর জন্য বিশেষ রহমত অপেক্ষা করছিলো- চারদিন পর ২৭ ফেব্রুয়ারী সন্দ্বীপে তাঁর প্রথম পুত্রসন্তান ভূমিষ্ঠ হয়।

৭৩ বছর আগে জন্মগ্রহণকারী সে শিশুটিই আজকের ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, যিনি বর্তমান অন্তর্বর্তী কালীন সরকারের একজন মাননীয় উপদেষ্টা। আজ ২৭ ফেব্রুয়ারী, শুভ জন্মদিন - ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।

ওদিকে হুলিয়াজনিত কারনে সরকারি কলেজের চাকুরীতে নির্বাচিত হয়েও তাতে আসিফুল হক খানের যোগদানে যে অনিশ্চিয়তা দেখা দিয়েছিল তা কেটে যায় গোয়েন্দা কর্মকর্তা মুহম্মদ আমিনউল্ল্যাহ’র নেপথ্য তৎপরতায়।

১৯৫২ সালের শেষদিকে তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সার্ভিসে সরকারী চাকুরীতে যোগ দিয়ে ঢাকা সরকারী কলেজে প্রভাষক হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং অতঃপর দেশের বিভিন্ন সরকারী কলেজে অধ্যাপনা ও প্রশাসনিক দায়িত্ব সাফল্য ও সম্মানের সাথে পালন করে ১৯৮০ সালে চট্টগ্রাম সরকারী কলেজের উপাধ্যক্ষ হিসেবে সুদীর্ঘ শিক্ষকতা জীবন শেষ করেন।

অধ্যাপক আসিফুল হক খানের জন্ম ১৯২৩ সালে সন্দ্বীপের হরিশপুরে। তাঁর বাবার নাম মৌলানা আব্দুল হাকিম খান এবং মায়ের নাম বিবি হালিমা খাতুন।

ব্যক্তিজীবনে অধ্যাপক আসিফুল হক খান অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ, অমায়িক, নিরহংকার ও প্রচারবিমুখ একজন সজ্জন ব্যাক্তি ছিলেন। ১৯৯৫ সালের ১৫ই জুন ৭২ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় ইন্তেকাল করেন।

ভাষার মাস এ ফেব্রুয়ারীতে মহান ভাষাসৈনিক এবং শিক্ষাব্রতী অধ্যাপক আসিফুল হক খানের প্রতি পরম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।

# ডা. এম ফারুক ইউ চৌধুরীঃ লেখক, গবেষক এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রাক্তন কন্সালটেন্ট faruqchy@gmail.com