বট অথবা অশ্বথ গাছের বিশাল বিস্তৃতির কথা কে না জানে। কিন্তু বুনো গাব গাছও যে বিরাট বট গাছের আকার ধারণ করতে পারে সেটা হয়তো অনেকে নাও জানতে পারেন। সন্দ্বীপের এমনি একটি প্রাচীন বুনো গাব গাছের কথা বলছি।
দেলোয়া খাঁ সড়ক ঘেসে মুছাপুর পণ্ডিতের হাটের পুকুর পাড়ের উত্তর- পূর্ব কোনে অবস্হিত প্রাচীন গাব বৃক্ষটি শুধু পুকুর পাড় নয় হাটেরও বিরাট একটি অংশকে অপরূপ শ্যামলিমায় আচ্ছাদিত করে রেখেছে। শুরুতেই বলে রাখি, পঞ্চবটী ( বট, বিল্ব, অশ্বথ, অশোক, আমলকী ) গোত্রের পর্যায়ে না পড়লেও খ্যাতি ও বয়সের দিক থেকে এটিকে আমি বনেদি বলছি। কথায় আছে গাছের বয়স হয় কিন্তু গাছ কখনো বুড়ো হয়না। গাছের শাখা প্রশাখা এবং পাতা সর্বদায় চির নতুন, চির সবুজ। এ গাছের পাতা গুলো কালচে সবুজ। গাছের বিরাট বেস্টনী, সমৃদ্ধ দেহ ও বড় বড় কাণ্ডের রং কালো। গাছের বয়স জানলে সবাই চোখ কপালে তুলবেন ! এ গাছের বয়স নাকি প্রায় চার শত বছর! কেউ বাড়িয়ে বলেন পাঁচ শ বছর !! যদি তাই হয় তাহলে ধরে নেয়া যায় মোগল সম্রাট ঔরঙ্গযেবের আমলেই মাথা তুলেছে গাছটি। এ সময় মোগলদের এক বিদ্রোহী নৌ সেনাপতি দেলোয়ার খাঁ নিরাপদ নৌঘাটি বিবেচনায় সন্দ্বীপের মায়াজালে জড়িয়ে পড়েন এবং দিলাল রাজা নামে সন্দ্বীপকে ম্বাধীন পরগনা হিসাবে শাসন করতে থাকেন। আজও দেলোয়ার খাঁ সড়কটি তাঁর স্মৃতি বহন করছে।
আশির দশকে পণ্ডিতের হাটে ছিল "জোনাকী সংঘ", আলোড়ন সৃষ্টিকারী একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন । জোনাকী সংঘ ছিল গাব গাছটির মুখোমুখি । এ সংগঠন থেকে প্রতি বছর শুকনো মৌসমে বাণিজ্যিক ভাবে দুটি নাটক উপহার দেয়া হতো। নাটকের রিহার্সাল করতে করতে ঘেমে গেলে সবাই এই গাব গাছের নীচে এসে ক্লান্তি দূর করতাম, প্রশান্তি নিতাম। সন্দ্বীপের বাইরে গেলে প্রসঙ্গক্রমে স্মৃতি কাতর হয়ে কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে : আচ্ছা পণ্ডিতের হাটের সেই গাব গাছটা কি এখনও আছে ?
গাব গাছ খুব ধীরে বাড়ে। শক্ত জাতের গাছ। ঝড় বাতাস সহজে কাবু করতে পারে না। ছোট বেলায় আমরা বুনো গাবের ছোট ডাল কেটে ডাংগুলি খেলার ডাং ছাগা বানাতাম। গাব ফল পাকা আরম্ভ হলে খুশির সীমা থাকতো না। এখনকার মত এত বিদেশি ফল বাজারে ছিলনা। ঘন বিস্তৃত বন জঙ্গলে ঠাসা ছিল গ্রাম গুলো। এক একটা বনের ভেতরে ঢুকলে বের হবার পথ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়তো। কত রকমের টক ও মিষ্টি বুনোফল যে পাওয়া যেতো ! গাব ফল পাকলে হলুদ হয়ে উঠতো। ছোটরা দলবেধে গাছে উঠে কে কার আগে পেড়ে মুখে দেব তা নিয়ে প্রতিযোগিতায় মেতে উঠতাম। গাবের পাতা সিদ্ধ করে শুকিয়ে জুঙ্গুর বা মাথলা বানানোর কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত হতো। বিশ পঁচিশ বছর আগেও জুঙ্গর ছাড়া কোন গেরস্হের বর্ষা পার হতনা। আমাদের সন্দ্বীপে গাব পাতার বিড়িও দেখেছি। খুব কড়া র্বিড়ি ! কৃষক ও কৃষি মাঠের বদলারা খেতেন। একবার আমি শখ করে টানতে গিয়ে তামাক-সুকার উৎকট মাত্রায় দম আটকে বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলাম। সুতার তৈরী নতুন জাল টেকসই করতে গাবের ছালের কসের পানিতে ভিজিয়ে রাখা হতো। কচি গাবের আঠা আমরা ঘুড়ি বানানোর কাজে ব্যবহার করতাম। কত রং বেরঙের ঘুড়ি যে আকাশে উড়তো তখন!
পণ্ডিতের হাটের এই গাছটি কিন্তু পুরুষ প্রজাতির। ফুল হয় কিন্ত ফল দেয়না। ফলে নিশাচর বাদুরের আনাগোনা নেই। গাছটিকে জড়িয়ে আবার আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেছিল একটি অশ্বথ গাছ। সম্প্রতি গাব গাছের নিরাপত্তার তাগিদে অশ্বথ গাছটি কেটে ফেলা হয়েছে।
পণ্ডিতের হাট সংলগ্ন পশিচম দিকের বসবাসকরী পূর্ব পুরুষদের মালিকানায় ছিল এই গাছ ও ভূমি। অবশ্য মূল মালিক ও ওয়ারিশানদের কাছ থেকে কখন কিভাবে এই মালিকানা বেহাত হয়ে গেছে কেউ বলতে পারে না। অশিতিপর বৃদ্ধরা বলেন, তাঁদের দাদা এবং দাদার দাদারাও নাকি ছোট বেলা থেকে গাছটিকে এরকমই দেখে আসছেন। অথচ অনঙ্গ সেন, এবি এম ছিদ্দিক চৌধুরী, ড, রাজীব হুমায়ুন প্রমুখের লেখা সন্দ্বীপের ইতিহাস গ্রন্হে গাছ গাছালি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনায় কোথাও এটির স্পর্শ পায়নি। পুন্যাল গাছের কথা আছে। পুন্যাল দেশের একটি বিরল প্রজাতির গাছ যা কেবল সন্দ্বীপেই হয়। সন্দ্বীপের এই পুন্যাল কাঠের ব্যবহার, পুন্যালের ভেষজ গুন ও বিপনন সম্পর্কে কমরেড মজফফর আহমদের একটি চমৎকার লেখা আছে কিন্তু আলোচ্য গাব গাছটি সম্পর্কে নেই। অথচ কেবল সন্দ্বীপ নয় পুরো চট্টগ্রামেও এত বড় বয়সী গাব গাছ আছে কিনা সন্দেহ। এমনকি গোটা বাংলাদেশে এ ধরণের গাব গাছ আছে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি। যেমন-- কালি গঞ্জের মল্লিকপুরে আছে এশিয়ার বৃহত্তম ও প্রাচীন গাব গাছ। ১১ একর জমি জুড়ে রয়েছে গাছটি। ৩০০ বছর বয়সী আর একটি গাব গাছ আছে দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলায়। এ ছাড়া আছে নরসিন্ধি জামিয়ার গাব গাছ। এসব গাব গাছ এলাকাবাসী, বৃক্ষ ও পরিবেশ প্রেমিকেরা সযত্নে রক্ষা করে চলেছে। দূর দূরান্ত থেকে দেখতে আসে ভ্রমন পিপাসুরা। অনেকটা পর্যটন স্পট হয়ে উঠেছে। সে ক্ষেত্রে পণ্ডিতের হাটের এই গাছটির এ ধরণের খ্যাতি না থাকলেও জনমনে ব্যতিক্রমি একটি আবেদন ছিল এবং এখনও খানিকটা রয়েছে বৈকি। গাছটিকে ঘিরে আলাদা একটি মাঙ্গলিক প্রেক্ষাপট আছে। সে দৃষ্টিকোন থেকে শুভ কামনায় গাছের বিস্তৃত শেকড় জুড়ে মোমবাতি জ্বালানো হতো সন্ধ্যায়। সেটি কিন্তু সনাতনী ধারার কোন দেব বৃক্ষের মনোভাব থেকে নয়। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সব দোকানী ও অনুরাগীরা প্রদীপ প্রজ্জ্বলনে অংশ নিত। তখন তো আর বৈদ্যুদিক বাতি ছিলনা। ফলে অজস্র মোম প্রদ্বীপের মায়াময় আলো পণ্ডিতের হাটকে ভিন্নতর সৌন্দর্য ও পবিত্রতায় উদ্ভাসিত করতো। এখনও নিষ্প্রভ আলোয় মোম বাতি জ্বলে দু`চার টা । তা ছাড়া ফতোয়া আরোপিত বর্তমান সমাজ আগের যে কোন সময়ের তূলনায় এসব ক্ষেত্রে অসহিষ্ণু।
আবার বড় বড় অশ্বথ, বট গাছকে ঘিরে বিভিন্ন এলাকায় যেমন জীন পরী, ভুত প্রেত নিয়ে জনশ্রুতি থাকে এখানে তা নেই। গানের পাখিরাও খুব একটা আসেনা। অন্যদিকে মানুষের ব্যাপক সমাগম থাকার করণে পেঁচা, শাপ, বাজ কুডাল (কুড়কাল) প্রভৃতি আবাস গড়ে তুলতে পারেনি। ফলে ভৌতিক গল্পেরও অবতারণা হয়নি।
তা সত্বেও যে ব্যতিক্রমী জনশ্রুতি আছে সেটি রীতিমত বিস্ময়কর! এ গাছের পাতা ছিড়লে বা ডাল কাটলে নাকি সাথে সাথে ঐ লোকের গায়ে জ্বর দেয়, নানা রকম অমঙ্গল হয়। আসলে হয়েছে কি, জনশ্রুতির কারণে মনের দুর্বলতায় পাতা ছিড়লে কারো জ্বর এসে যাওয়া টাও কিন্তু অমূলক নয়। ১৯৬৯ খ্রি, থেকে আমি এ গাছটির সাথে পরিচিত, হাটে গেলে মুগ্ধ নয়নে তাকাই এবং এটির ছায়া ও মায়া নিয়ে মজে আছি এখনও ।
ও হ্যাঁ, আসল কথা কিন্তু এখনও বলা হয়নি। গাবতলায় শণের ছাওয়া একটি ছোট্ট কুড়ে ঘর ছিল। ঘরটি ছিল জমির শাহ হুজুরের বিশ্রামের স্হান। কে এই জমির শাহ হুজুর ? জানা যায় তিনি ছিলেন একজন সুফি সাধক। আসা যাওয়ার পথে হুজুর এখানে বিশ্রাম নিতেন। আল্লাহর নাম কালাম জপতেন । ভক্তরা, দোয়া প্রার্থীরা ভীড় জমাতেন। জমির শাহ হুজুরের মূল আস্তানা কোথায় ছিল এ সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে কেউ জানাতে পারেনি। আর দখলদারদের উৎপাতে সেই স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র কুঁড়ে ঘরটি অনেক আগেই উচ্ছেদ হয়ে গেছে। কিন্তু তা সত্বেও হুজুরের প্রতি এখানকার জনমনে শ্রদ্ধা ও ভক্তি আজও অটুট। আমি ছোট্ট কুড়ে ঘরটি দেখেছি। এখন তো মাশাল্লাহ গাবগাছের শিকড় জুড়ে যার যেমন খুশি দোকান ঘর তুলে এক শ্রেণির দোকানদার দিব্যি আরামে ব্যবসা করছে। মনে হচ্ছে গাছটার পায়ে নিষ্ঠুর বেড়ী পড়িয়ে দিয়েছে। তাঁর সমৃদ্ধ দেহ বেস্টনি, বিস্তৃত নান্দনিক শেকড়, সুশোভিত পাদ দেশ এখন সম্পূর্ণ লোকদৃষ্টির আড়ালে ।