আমার চাকুরী জীবনের শুরু রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার অফিসে ১৯৮৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী সহকারি কমিশনার হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে। সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট এবং কুড়িগ্রাম জেলাসহ রাজশাহী বিভাগে দীর্ঘ ০৯ (নয়) বছর সহকারি কমিশনার, সিনিয়র সহকারি কমিশনার ও এনডিসি পদে কর্মরত ছিলাম। কুড়িগ্রাম জেলায় নেজারত ডেপুটি কালেক্টর পদে কর্মরত থাকাবস্থায় ১৯৯৬ সালের জুলাই মাসে বিভাগীয় কমিশনার অফিসে ঢাকায় বদলীর জন্য আবেদন করি। দীর্ঘদিন আবেদনপত্র তৎকালিন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে পড়েছিল কোন আদেশ হচ্ছিল না।
জানুয়ারি ১৯৯৭ সালে বদলীর বিষয়ে খোজ-খবর নেয়ার জন্য সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব জনাব সফিউর রহমানের একান্ত সচিব আশফাক সাহেবের সাথে সাক্ষাত করি। তিনি আমাকে একটা সুপরার্মশ দিয়ে বললেন” “আপনি সরাসরি সচিব মহোদয়ের সাথে সাক্ষাত করেন দেখবেন কাজ হয়ে যেতে পারে”
আমি যথারীতি সচিব মহোদয়ের সাথে দেখা করে আমাকে ঢাকা বিভাগে বদলীর জন্য অনুরোধ করি। আমি বললাম দীর্ঘ ০৯ (নয়) বছর রাজশাহী বিভাগে আছি আমার নিজ জেলা নোয়াখালী আমাকে ঢাকা বিভাগে বদলী করা হলে বাড়ীতে বৃদ্ধ বাবা মাকে দেখতে পারব, যাতায়াতে সুবিধা হবে। তখনও যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হয়নি, কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকায় আসতে ফেরী পারাপারসহ ১৩/১৪ ঘন্টার বেশী সময় ব্যয় হতো, ঢাকা থেকে নোয়াখালীর চৌমুহনী যেতে আরো ৬/৭ ঘন্টা লেগে যেতো।
যাহোক আমার বক্তব্য শুনে সচিব মহোদয় বললেন আবেদন কপি সাথে আছে কি? ভাগ্যিস আমার সাথে আবেদনের একটা কপি ছিল। আবেদনটি দেয় হল। স্যার আবেদনের উপর লিখলেন “আবেদনকারীর বক্তব্য সঠিক হলে তাকে ঢাকা বিভাগে বদলী করা হোক” এবং এপিডি আশরাফ স্যারকে মার্ক করেন। আবেদনটি আশরাফ স্যারের নিকট দিলেঐদিনই তিনি আমাকে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার কার্বযালয়ে ন্যাস্ত করে আদেশ জারি করেন।
বদলীর আদেশ পেয়ে কুড়িগ্রাম ফিরে গেলাম। জেলা প্রশাসক দীর্ঘ একমাস পর ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭ সালে আমাকে কুড়িগ্রাম থেকে অবমুক্ত করেন। ইতোমধ্যে বিভাগীয় কমিশনার ঢাকা আমাকে মানিকগঞ্জ জেলায় সিনিয়র সহকারী কমিশনার হিসেবে পদায়ন করে। আমি যথারীতি আমার সপ্তম কর্মস্থল মানিকগঞ্জে ১৭ ফেব্রুয়ারি যোগদান করি। মানিকগঞ্জে সার্কিট হাউজে দুপুর ১২:৩০টা আমার সাথে ব্যাচম্যাট হুমায়ুন কবিরের দেখা হয়। বন্ধু হুমায়ুন বেশ আন্তরিকভাবে গ্রহণ করল। এ সময় মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক ছিলেন জনাব আব্দুর রাজ্জাক স্যার। আমি যথারীতি জেলা প্রশাসকের নিকট যোগদান পত্র দাখিল করলাম। তখন নেজারত ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন আমার ব্যাচম্যাট আয়াত উল্যাহ মজুমদার । এনডিসি মজুমদার অমায়িক ও আন্তরিক বাসা বরাদ্দ প্রাপ্তি, যানবাহনসহ অন্যান্য সহযোগিতা তার নিকটপেয়েছি। মানিকগঞ্জ জেলা আবাসিক এলাকা বেউথায় একটি পুরাতন ভবনের নীচতলায় আমার নামে বাসা বরাদ্দ দেয়া হল। আমার পরিবার তখন গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় আমার শ্বশুর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বাসায় অবস্থান করছিল। ফেব্রুয়ারীর শেষ সপ্তাহে আমি আমার স্ত্রী সৈয়দা শারমিন বেলায়েত, দুই ছেলে সময় ও প্রত্যয়কে নিয়ে বাসায় উঠলাম। তখন বড়ছেলে সময়ের বয়স আড়াই বছর ছোট ছেলে প্রত্যয়ের বয়স একমাস ।
পদ্মা, যমুনা, কালিগঙ্গা, ধলেশ্বরী ও ইছামতি নদী বিধৌত অনেক ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক নিদর্শন সমৃদ্ধ জেলা মানিকগঞ্জ। মানিকগঞ্জ জেলায় এসে আমি লক্ষ্য করলাম বৃহত্তর ঢাকার ৫টি জেলার মধ্যে মানিকগঞ্জকে একটু ভিন্ন প্রকৃতির। ঢাকার অন্য ৪ (চার)টি জেলার তুলনায় মানিকগঞ্জ বেশ পিছিয়ে, এখানকার বিভিন্ন উপজেলার সাথে সদর উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত, ব্যবসা-বাণিজ্যও পিছিয়ে থাকা জনপদ, তেমন কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। দু-চারটি পরিবার ব্যতীত এলাকার বেশিরভাগ জনসাধারণ অর্থনৈতিকভাবে সবল নয়। বেশীর ভাগ মানুষ সহজ-সরল। উত্তরবঙ্গের সাথে এ জেলার বেশ মিল পাওয়া যায়। তবে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে মানিকগঞ্জ জেলার একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে । এ জেলার ঐতিহাসিক স্থাপনার মধ্যে জাতীয় কবি কাজী নজরুলের স্মৃতি বিজড়িত স্থাপনা ও পাঠাগার, বালিয়াটি জমিদার বাড়ী, তেওতা জমিদার বাড়ী, তেওতা নবরত্ম মঠ, বেতিলা জমিদার বাড়ী, মত্তের মঠ, রামকৃষ্ণ মিশন সেবা আশ্রম, শিব সিদ্ধেশ্বরী মন্দির, নারায়ণ সাধুর আশ্রম, মাচাইনগ্রামের ঐতিহাসিক মাজার আজাহার পীর সাহেবের খানকা শরীফ ও পুরাতন মসজিদ ইত্যাদি।
মানিকগঞ্জের ঐতিহ্য ঝিটকার হাজারী গুড়ের সুনাম রয়েছে সারা দেশব্যাপী। হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা ও শিবালয় উপজেলার আরুয়াসহ আশপাশের গ্রামে শীতের শুরুতে গাছিরা বিশেষ পদ্ধতিতে এ গুড় উৎপাদনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন।খাটি হাজারী গুড় প্রতি কেজি ৭/৮ শত টাকায় বিক্রি হয়।
জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলামের স্মৃতি বিজড়িত মানিকগঞ্জ জেলার জনসাধারণ আদিকাল থেকেই সংগীত পিপাসু। শিবালয় উপজেলায় এখনও কবি নজরুলের স্মৃতির নিদর্শন রয়েছে। জারি, সারী, মুর্শিদি, মারফতি, মর্সিয়া, ভাটিয়ালী, বাউল গানসহ বিশাল লোক সংগীতের আধার এ মানিকগঞ্জ। নববর্ষ বরণ, নবান্ন, বিবাহ, ধর্ম-কর্মে সংগীত হলো অনিবার্য অনুসংগ। রাম প্রসাদের গান, নিধুবাবুর টপ্পা, দ্বিজেন্দ্রগীতি, রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল সংগীত অন্যতম। এখানকার বাউল কালুশাহ ছিলেন লালনের সমসাময়িক, এছাড়া ছিলেন উবা পাগলা, আজাহার শাহ এর মরমীগান অন্যতম। মানিকগঞ্জের শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম জুলমত আলী সরকার, সুফি সাধক দেওয়ান রশিদ, বদর উদ্দিন বয়াতী, খন্দকার আজাহার আলী খান বয়াতী, ওস্তাদ রমেশচন্দ্র ঘোষ, জলমুদ্দিন বয়াতী, আকবর আলী বয়াতী, আবদুল হালিম চৌধুরী, মমতাজ আলী খান, ওসমান খান, রাধা বল্লভ সরকার, গিয়াস উদ্দিন শিকদার (গেন্দু বয়াতী), মনিরুদ্দিন ওরফে মধু বয়াতী, ইউসুফ আলী বয়াতী, বজলু দেওয়ান, মোহাম্মদ চান মিয়া, দবির উদ্দিন বয়াতী, নুরুন্নাহার বেগম , কদম আলী বয়াতী, সাইদুর রহমান বয়াতী, ওস্তাদ রফিকুল ইসলাম, বৈদ্যনাথ সরকার, নীনা হামিদ, রেবেকা সুলতানা, আবিদা সুলতানা, কিরণ চন্দ্র রায়, পিলু মমতাজ, ঝর্ণা রহমান। লোক সংগীতের অনন্য শিল্পী মমতাজ সারা দেশবাসীর নিকট জনপ্রিয় ও সুপরিচিত। তিনি একাধারে লোকসংগীত শিল্পী, সুরকার, গীতিকার, সমাজসেবক ও চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। তিনি বাউল শিল্পী মধু বয়াতীর কন্যা। চিত্রজগতের অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেতা, নির্মাতা ও পরিচালক খান আতাউর রহমান মানিকগঞ্জের কৃতি সন্তান। ১৯৯৮ সালে অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী ড.অমর্ত্য সেন মানিকগঞ্জ জেলার মত্ত গ্রামের কৃতি সন্তান। বৃটিশ ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা হীরালাল সেনের বাড়ী মানিকগঞ্জে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা কিশোরীলাল রায় চৌধুরী মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার সন্তান। আরো আছেন সুপরিচিত ব্যাক্তিত্ব আব্দুল লতিফ বিশ্বাস, ড.দীনেশ চন্দ্র সেন, খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন। ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ মানিকগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন।
আমি ২ (দুই) বছরের বেশি সময় মানিকগঞ্জ জেলায় কর্মরত ছিলাম। এ জেলায় থাকাকালে ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যা, বন্যায় ত্রাণ সামগ্রী বিতরনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মানিকগঞ্জ সফর, টোটাল লিটারেসি প্রোগ্রাম (টিএলএম), আবাসিক কোয়ার্টার মাঠে ব্যাডমিন্টন খেলা, আবাসিক এলাকায় কল্যাণ সমিতির কার্যক্রম পরিচালনাসহ অনেক বিষয় মনের মুকুরে ভেসে উঠছে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল আমার বড়ছেলে সময়ের স্কুল জীবন মানিকগঞ্জের শিশুমঞ্জুরীতে শুরু হয়। সে সময়ের কিছু ঘটনা, স্মৃতি আজও মানসপটে ভাস্বর হয়ে আছে তা আজ এখানে উল্লেখ করছি।
১৯৯৮ সালের ভয়াবহ ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় পার্বত্য এলাকা ব্যতীত প্রায় সারাদেশ বন্যকবলিত হয়েছিল। এর মধ্যে মানিকগঞ্জ জেলা বন্যায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আমাদের বেউথা আবাসিক এলাকার প্রায় ৪ ফুট পানির নীচে ডুবে যায়। আমার ও আমার প্রতিবেশী মাহফুজ স্যার পাশাপাশি নীচতলায় ছিলাম । মাহফুজ স্যার তখন জাপানে একটি বৈদেশিক প্রশিক্ষণে ছিলেন। মাহফুজ ভাবী বাসায় মালামাল নিয়ে বেশ কষ্ট করেছেন। নীচ তলার বাসার জানালার ১/৩ ভাগ ডুবে যায়। খাট, আলমারী, ড্রেসিং টেবিল ও অন্যান্য আসবাবপত্র ইট দিয়ে উপরে তুলে ও রক্ষা করতে পারিনি। আমার গিন্নী ও ছোট ২ ছেলে সময় ও প্রত্যয়কে ঢাকায় আমার সম্মুন্দী সুমনের বাসায় রেখে আমি ডাক বাংলোয় আশ্রয় নেই। আমরা ত্রাণ বিতরণ ও সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করি। জেলা প্রশাসক মহোদয় সামগ্রিকভাবে সকল কার্যক্রম তদারক করতেন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়। এমনকি কালেক্টরেট ভবন, এস.পি. অফিসেও জনসাধারণ আশ্রয় গ্রহণ করে । এ সময় নৌকায় ও স্পিডবোটে আমাদের অফিসে যাতায়াত করতে হতো। এ এক অবর্ণনীয় কষ্ট। সাধারণ মানুষকে আরো বেশী কষ্ট সহ্য করতে হয়। এ বন্যা প্রায় ৬৫ দিন স্থায়ী ছিল। এটি ১৯৮৮ সালের বন্যাকেও ছাড়িয়ে যায়। তবে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ, আশ্রয় কেন্দ্র পরিচালনা ইত্যাদি জেলা প্রশাসন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ সফলভাবে সুসমন্বয় করেন।তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মানিকগঞ্জ আগমন করেন এবং জনসাধারণের মাঝে ত্রাণ সামগ্রীবিতরণ করেন। এ সময় বন্যা মোকাবেলায় সরকার ও প্রশাসন বেশ সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছিল।
বেউথা আবাসিক এলাকায় আমাদের সন্তানদের সাতার শেখানোর সময় একটি ঘটনা আজও আমার মনে গেঁথে আছে। তখন মাহফুজ স্যার মানিকগঞ্জে এডিসি (সার্বিক) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মাহফুজ স্যার কন্যা ইষ্টিকে সাতার শেখাচ্ছেন, আমি সময় ও প্রত্যয়কে নিয়ে তাদেরকেও সাতার শেখানোর জন্য পুকুর ঘাটে ছিলাম। আমার বড় পুত্র সময় পুকুর ঘাটের সিড়িতে দাড়িয়ে ছিল। প্রত্যয়কে আমার হাত থেকে মাহফুজ স্যার নিলেন আরেক হাতে ইষ্টি। আমি সময়কে নিয়ে সাঁতার শেখানোর তালিম দিচ্ছিলাম। এ সময় দেখলাম ইষ্টি ডুবে যাচ্ছে, স্যার ইষ্টিকে রক্ষা করতে গিয়ে প্রত্যয়কে সামলাতে পারছিলেন না, প্রত্যয় হাত থেকে ছুটে যাবার উপক্রম, আমি দ্রুত সময়কে সিড়ির উপর রেখে প্রত্যয়কে ধরে তুললাম, এদিকে স্যার ও ইষ্টি গভীর পানির দিকে তলিয়ে যাচ্ছেন, পাড়ে উমেদার সিকান্দারকে ডাকলাম, প্রত্যয়কে সিকান্দারের হাতে দিয়ে আমি স্যার ও ইষ্টির দিকে এগুলাম। স্যার, আমি ও ইষ্টি সকলে পানিতে হাবুডুবু খেয়ে উপরে সিড়িতে উঠলাম। একটি মহা বিপদ থেকে আল্লাহর রহমতে রক্ষা পেলাম। বেউথাকোয়াটারের পুকুরের এ ঘটনা এখনও মনে পড়ে।
মানিকগঞ্জ অবস্থানকালে দুটি মৃত্যুর ঘটনা আমার মনের মাঝে গভীরভাবে দাগ কেটে আছে। হৃদয় বিধারক একটি হল সড়ক দুর্ঘটনায় আমাদেরই কনিষ্ঠ সহকর্মি কামরুন্নাহারের মৃত্যু আরেকটি জেলা প্রশাসক মোজাহার স্যারের কন্যা লরেনের মৃত্যু। আমার যতদুর মনে পড়ে ১৯৯৮ সালের প্রথম ভাগে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার আসনে সংসদ সদস্য পদে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উপ-নির্বাচন উপলক্ষ্যে বিভিন্ন জেলা থেকে ম্যাজিস্ট্রেটগণ নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করতে মানিকগঞ্জ আসেন। প্রত্যেক কেন্দ্রে একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়া হয়। অত্যন্ত উৎসব মুখর পরিবেশে অবাধ-সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ম্যাজিস্ট্রেট কামরু্ন্নাহর দায়িত্ব পালন করে নির্বাচনের পরদিন ঢাকায় বাসা স্থানান্তরের কাজ করছিলেন। সব গুছিয়ে মালামাল নিয়ে ট্রাকযোগে সে ঢাকায় রওয়ানা হয়। পথিমধ্যে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বাথুলী নামক স্থানে ট্রাকটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কের পাশের বৃক্ষের সাথে ধাক্কা লাগে। ঘটনাস্থলে কামরুন্নাহার মারাত্মক ভাবে আহত হয়। অচেতন অবস্থায় তাকে মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসারজন্য তাকে ঢাকায় নেয়া হয় চিকিৎসদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে তিনদিন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকে কামরুন্নাহার মুত্যুবরণ করে। তার এ অকাল মৃত্যতে মানিকগঞ্জ কালেক্টরেটের সকল কর্মকর্তা কর্মচারী শোকহত হয়ে পড়েন।
কামরুন্নাহার ছিল একজন মেধাবী, পরিশ্রমী, উদ্যমী, সাহসী, সৎ ও প্রাণখোলা প্রকৃতির প্রাণবন্ত কর্মকর্তা। আমরা তাকে বেশ পছন্দ করতাম, কোন কাজ দেয়া হলে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে সে তার দায়িত্ব পালন করতো। এমন একজন অসাধারণ কর্মকর্তার অকাল প্রয়ানে আমরা হারালাম এক মেধাবী ও সম্বাবনাময় কর্মকর্তাকে। এটি তার পরিবারের জন্য এক বিশাল ক্ষতি তার মা এখনো এ কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছেন। আমি তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।
মানিকগঞ্জ জেলার আরেকটি মৃত্যুর ঘটনা আমার হৃদয়কে নাড়া দেয় সেটি হল জেলা প্রশাসক মোজাহার স্যারের কন্যা লরেনের অকাল মুত্যু। মোজাহার স্যার জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদানের কিছুদিন পরে লরেন দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়। তখন লরেন উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়তো, তার রোগ সনাক্ত হবার পর চিকিৎসার জন্য সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তার কোলন ক্যান্সার অপারেশনের জন্য দিল্লীর টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালনেয়া হয়। অপারেশনের পর ঢাকায় ডেলটা হাসপাতাল পরে শমরিতা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আমরা তার জন্য রক্ত দেয়ার ব্যবস্থা করি। নিয়মিত শমরিতা হাসপাতালে যেতাম এ ব্যাপারে মাহফুজ ভাবী অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন। মোজাহার স্যার সকল প্রকার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন। সকলকে কাঁদিয়ে কোলন ক্যান্সার সনাক্তের ৫ মাস পর সম্ভবত ২৫সে জুলাই ১৯৯৯ এ লরেন মৃত্যুবরণ করে তখন তার বয়স মাত্র ১৮ বছর। তার এ অকাল প্রয়াণ মোজাহার স্যার ও ভাবী যেমন গভীর শোকাহত হয়েছেন এবং আমরা খু-উ-ব কষ্টে পেয়েছি। তার পরিবারের এ অপূরণীয় ক্ষতি কোন দিন পূরণ হবার নয়। তার এ অকাল মৃত্যু আমার জীবনে গভীর দাগ কেটে আছে। এ ধরণের মৃত্যু ভোলা যায় না, মেনে নেয়া যায় না। মহান আল্লাহ সব ভাল জানেন। মহান আল্লাহ তায়ালা কামরুন্নাহার ও লরেনকে জান্নাতবাসী করুন।
আরো কিছু ঘটনা আছে যেটি এখনো মাঝে মধ্যে স্মৃতিপটে ভেসে উঠে আমরা মানিকগঞ্জ থেকে দল বেধে ঢাকা বানিজ্য মেলায় যেতাম ঢাকার প্রতি তখন আলাদা একটি আকর্ষণ ছিল। মেলায় ঘোরাফেরা করে রাত ১১/১২টায় বাসায় ফেরা হতো। ফেব্রুয়ারীর বাংলা একাডেমীর বই মেলায় এসে বই কেনা হতো। ঢাকার কাছে হওয়ায় মানিকগঞ্জ থেকে এ সুবিধা গুলো ভোগ করা সম্ভব হতো।আয়াতউল্যা বদলী হয়ে যাবার পর এনডিসির দায়িত্বভার আমার উপর বর্তায়, তাই একাজগুলো আমাকেই আয়োজন করতে হতো। মাঝে-মধ্যে যমুনা নদীতে স্পিড বোটে ভ্রমণের আয়োজন করা হতো।
মানিকগঞ্জ অফিসার্স ক্লাবে বিভিন্ন খেলাধুলার ব্যবস্থা ছিল, নিয়মিত লন টেনিস খেলা হতো, মাঝে-মধ্যে তাস খেলা হতো। খেলার প্রতি আমার একটা আলাদা আকর্ষণ ছিল। ক্লাবের পক্ষে থেকে প্রতি বছর বনভোজনের আয়োজন করা হতো। পাশাপাশি কালেক্টরেটের কর্মকর্তাদের বাৎসরিক অনুষ্ঠান হতো। সকলের মধ্যে একটা হৃদ্যতাপূর্ণ আন্তরিক সর্ম্পক সৃষ্টি হয়।
আমাদের ব্যাচের কর্মকর্তা ছিল বেশী আমি হুমায়ুন, আয়াত উল্যা, সেলিনা, মীর আলী রেজা.শাহাদাত, এমদাদ, নিতাইরদ দাস, পরের ব্যাচে ছিল ফৌজিয়া জাফরীন, মহীউদ্দিন, মোজাহেদ ও ননী গোপাল বিশ্বাস, ৯ম ব্যাচের নাজমুল, ১০ম ব্যাচের দেবাশীষ, প্রনব, দেলোয়ার, ১১তম ব্যাচের মাহবুব ও আরেফিন, ১৫ তম ব্যাচের দেলোয়ারা , সোহেল , সিরাজুন নূর চৌধুরী, ১৮তম ব্যাচের সুভাষ সহ অনেকে ছিল। মাহফুজ স্যারের নেতৃত্বে মানিকগঞ্জ স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলেছি। একই ভাবে বেউথা মাঠে ব্যাডমিন্টন,ক্রিকেট খেলা হতো। নেপাল স্যার ও মোজাহেদ ভালো ব্যাডমিন্টন খেলতেন। মোজাহেদ ব্যাডমিন্টন খেলায় চ্যাপিম্পয়ন হতো। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হারুন স্যার এর শখ ছিল তরা সেতু এলাকা থেকে নদীর তাজা মাছ ক্রয় করা। মাঝে মধ্যে সেখান থেকে মাছ ক্রয় করে এনে আমরা সকলে শেয়ার করে নিতাম। জেলা পর্যায়ে থাকাবস্থায় যে আন্তরিক ও আত্মিক সর্ম্পক গড়ে উঠে সেটা কিন্তু ঢাকায় এসে আর ঐভাবে অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়নি।
সামগ্রিকভাবে মানিকগঞ্জ জেলায় প্রায় আড়াই বছর অবস্থানকাল অনেক স্মৃতি যেটি জীবন থেকে মুছে যাবার নয়। মানিকগঞ্জের অনেক দু:খ-বেদনা, হাসি-কান্না, ছোট ছোট অনেক স্মৃতি কথা এখন মনের মুকুরে অম্লান হয়ে আছে যা কখনও ভোলা যায় না।
আমাদের সকলের জীবন শান্তিময়, আনন্দময় এবং নিরাপদ থাকুক মহান আল্লাহর নিকট এটা কায়মন বাক্যে প্রার্থনা করি।
লেখক : ড. মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন, সাবেক সচিব, সেতু বিভাগ