আজ শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ || ২৯ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ শনিবার, ০৮:২২ পূর্বাহ্ন
সোমবার, ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫   |   sonalisandwip.com
সুফিবাদ ও ইসলাম ; প্রেক্ষিত বাংলাদেশ- মোহাম্মদ কাউসার ফারুক

ভূমিকা:

সুফিবাদ ইসলামের একটি গভীর আধ্যাত্মিক এবং রহস্যময় অংশ, যা মুসলিমদের মধ্যে আল্লাহর সাথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপনের উপর জোর দেয়।

এটি ইসলামের মৌলিক নীতিমালা—কুরআন এবং হাদিস—এর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, কিন্তু এর মূল উদ্দেশ্য হলো ঐশ্বরিক প্রেম এবং জ্ঞানের সন্ধানে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অর্জন ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা।

সুফিবাদকে প্রায়শই ইসলামের "তাসাউউফ" বলা হয়, যা শুদ্ধিকরণ, আধ্যাত্মিকতা এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উপর কেন্দ্রীভূত।

এটি ইসলামে কোনো নতুন সংযোজন নয়, বরং ইসলামের প্রথম শতাব্দী থেকেই এর উদ্ভব ঘটেছে। অষ্টম এবং নবম শতাব্দীতে এটি সুসংগঠিত রূপ লাভ করে, যখন সুফি সাধকরা ইসলামের আধ্যাত্মিক গভীরতা অন্বেষণ করতে শুরু করেন।

যদিও সুফিবাদ মূলত মধ্যপ্রাচ্যে উদ্ভূত হয়েছে, তবে এটি ভারত, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মতো দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে বিশেষভাবে প্রসার লাভ করেছে, যেখানে এটি স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে মিশে একটি অনন্য রূপ ধারণ করেছে।

এই প্রবন্ধে সুফিবাদের সারাংশ, এর প্রসারের ইতিহাস, ইসলামি বিধিবিধানে এর স্থান এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হবে।

সুফিবাদ কী?

সুফিবাদ ইসলামের একটি মিস্টিকাল ঐতিহ্য, যা বাহ্যিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ আধ্যাত্মিক সাধনার উপর জোর দেয়।

সুফিরা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর সাথে সরাসরি যোগাযোগ সম্ভব, এবং এর জন্য ধ্যান, জিকির (আল্লাহর নাম স্মরণ), ইসলামী সঙ্গীত, কাওয়ালী, এবং কঠোর আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে পথ অনুসরণ করা হয়। সুফিবাদের মূল লক্ষ্য হলো "ফানা" (আত্মবিলোপ) অর্জন করে আল্লাহর সাথে একাত্ম হওয়া।

এটি ইসলামের শরিয়াহ (বাহ্যিক আইন) এবং তরিকাহ (আধ্যাত্মিক পথ) এর মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপন করে। সুফিরা প্রায়শই সিলসিলা বা অর্ডারে সংগঠিত হয়, যেমন চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া, কাদিরিয়া, মোজাদ্দেদিয়া ইত্যাদি।

এটি শুধুমাত্র ধর্মীয় নয়, বরং সামাজিক সহিষ্ণুতা, বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে হৃদ্যতা, এবং প্রেমের বার্তা প্রচার করে।

সুফিবাদের প্রসার কীভাবে ঘটেছে?

সুফিবাদের প্রসার ইসলামের প্রথম যুগ থেকে শুরু হয়েছে। প্রথম সুফি সাধকরা যেমন হাসান বসরি (৭ম শতাব্দী) এবং রাবিয়া বসরি, ইসলামের আধ্যাত্মিক দিকগুলোকে গভীরভাবে অনুসন্ধান করেন। মধ্যযুগে এটি মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্য এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।

দক্ষিণ এশিয়ায় সুফিবাদের প্রসার ঘটে ১১ম-১২ম শতাব্দীতে, যখন সুফি সন্তরা ইসলাম প্রচারের জন্য এখানে আসেন। চিশতিয়া অর্ডারের মতো সুফি সম্প্রদায়গুলো ভারত উপমহাদেশে ইসলামের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

তারা স্থানীয় সংস্কৃতি, লোকজ সংস্কৃতি ভক্তি আন্দোলন এবং হিন্দু-বৌদ্ধ ঐতিহ্যের সাথে মিশে ইসলামকে গ্রহণযোগ্য করে তোলেন।

বাংলাদেশে সুফিবাদের প্রসার শুরু হয় ১২ম শতাব্দীতে, যখন সুফি সন্তরা যেমন হযরত শাহ জালাল রহ:, হযরতখান জাহান আলী রহ:, হযরত শাহ পরান রহ:সহ নাম নাজানা অনেকেই এবং হযরত শাহ সুলতান রুমি রহ: এখানে আসেন।

তারা বাণিজ্যপথ এবং সামরিক অভিযানের সাথে যুক্ত হয়ে ইসলাম প্রচার করেন, এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে স্নেহ ভালোবাসা ও পরোপকার করে ন্যায় ও বৈষম্যবিরোধী নীতি প্রচারের মাধ্যমে ধর্মান্তরিত করে ইসলামে দিক্ষীত করেন।

মুঘল যুগে এটি আরও প্রসারিত হয়, এবং বাংলায় সুফি দরগাহগুলো (যেমন হযরত শাহ জালালের মাজার) ধর্মীয় কেন্দ্র হয়ে উঠে।

সুফিরা শুধু ধর্ম প্রচার করেননি, বরং সামাজিক সম্প্রীতি, হিন্দু ধর্মের বর্ণপ্রথার পরিবর্তে মানুষের সমান মর্যাদা, বৈষ্যম বিরোধী ধারনা এবং দরিদ্রদের সেবা দান করে তাদের মন জয় করেন।

ইসলামি বিধিবিধানে সুফিবাদ কতটুকু সঠিক?

ইসলামি বিধিবিধান বা ফিকাহ মতে সুফিবাদের স্থান নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে।

অনেক ইসলামি স্কুল অফ থট, যেমন হানাফি, মালিকি, শাফিয়ি এবং হাম্বলি, সুফিবাদকে স্বীকৃতি দেয়, কারণ সুফিরা শরিয়াহ কঠোরভাবে পালন করে এবং এটিকে আধ্যাত্মিকতার ভিত্তি মনে করে এবং জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে কাছে টানে।

সুফিবাদকে ইসলামের অভ্যন্তরীণ মাত্রা হিসেবে দেখা হয়, যা বাহ্যিক আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, বিখ্যাত সুফি হযরত আল-গাজ্জালি রহ: ফিকহ এবং সুফিবাদকে একীভূত করে নতুন ধারার সংযোজন করেছেন।

তবে কিছু স্যালাফি এবং ওয়াহাবি চিন্তাধারায় সুফিবাদকে "বিদআহ" (নতুন উদ্ভাবন) বলে সমালোচনা করা হয়, কারণ এর কিছু অনুষ্ঠান যেমন সঙ্গীত বা দরগাহ পূজা (মাজারে ফুল সাঝিয়ে পুজার মতো আরাধনা করা, তবে মাজার বা কবর জেয়ারত নিয়ে তাদের দ্বিমত নেই) প্রথম যুগের ইসলামে ছিল না বলে মনে করা হয়।

তারা কোরআন ও সহিহ হাদিসের বাইরের কিছু কে ইসলাম মনে করতে চাই না।

যাই হোক, সুফিরা মনে করে তাদের সাধনা কুরআন এবং হাদিসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, এবং এটি ইসলামের আধ্যাত্মিক গভীরতা বাড়ায়।

আধুনিক সময়ে সুফিবাদকে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়, যা ইসলামের মূল মানবতাবাদী বার্তা প্রচার করে এবং অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদেরকে সহজে কাছে টানতে পারে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সুফিবাদ ও ইসলাম: বাংলাদেশে সুফিবাদ ইসলামের প্রধান রূপ হিসেবে বিদ্যমান, এবং এটি দেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার মূলে রয়েছে।

তাদের অধিকাংশই হানাফি মাজহাব ও সুফি সাধকদের হাত ধরে ইসলাম গ্রহনকরায় তারা সুফিবাদকে লালন করে।

১২তম শতাব্দীতে বখতিয়ার খিলজির বিজয়ের পর সুফি সন্তানরা বাংলায় ইসলাম প্রচার করে, যা স্থানীয় হিন্দু-বৌদ্ধ জনগণের মধ্যে ধর্মান্তরিত করে। যা এখনো বিদ্যমান।

হযরত শাহ জালাল শাহ রহ: সিলেটে, হযরত খান জাহান আলী রহ: বাগেরহাটে এবং অন্যান্য সুফিরা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে মসজিদ, খানকাহ এবং দরগাহ স্থাপন করেন।

এর ফলে বাংলাদেশে ইসলাম একটি সহিষ্ণু ধর্ম হিসাবে এবং সাংস্কৃতিকভাবে মিশ্রিত রূপ লাভ করে। সুফিবাদ এখানে ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রচার করে, যেমন উরস এবং মিলাদের মাধ্যমে।

আধুনিক বাংলাদেশে সুফিবাদ সামাজিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন এবং ধর্মীয় সহাবস্থানে ভূমিকা পালন করে, যদিও কিছু রক্ষণশীল ইসলামী স্করারদের দল বা গোষ্ঠী এর সমালোচনা করে।

এটি বাংলাদেশের ইসলামকে একটি অনন্য পরিচয় দিয়েছে, যা মধ্যপ্রাচ্যের কঠোর রূপ থেকে ভিন্ন।

উপসংহার : সুফিবাদ ইসলামের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা আধ্যাত্মিকতা এবং প্রেমের মাধ্যমে ধর্মকে সমৃদ্ধ করে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এটি ইসলামের প্রসার এবং সাংস্কৃতিক মিশ্রণের কেন্দ্রবিন্দু।

যদিও ইসলামি বিধানে এর সঠিকতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তবে এর ঐতিহাসিক ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না।

শিরক কর্মকান্ডকে বাদ দিলে সুফিবাদ নিয়ে তেমন সমালোচনা নেই।

ভবিষ্যতে সুফিবাদ ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রতীক হিসেবে বাংলাদেশে তার গুরুত্ব বজায় রাখবে।

 

  • লেখক: মোহাম্মদ কাউসার ফারুক
  • নির্বাহী পরিচালক
  • আল কোরআন ফাউন্ডেশন
  • বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম।