আজ মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৫ || ২৯ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ মঙ্গলবার, ০৯:৪৮ অপরাহ্ন
শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫   |   sonalisandwip.com
শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থা স্বচ্ছতা ও আমাদের নৈতিকতা : কাজী আনোয়ার হোসেন

কাজী আনোয়ার হোসেন

একটি জাতির আশা আকাঙ্খা ও স্বপ্নপুরণের বাস্তব প্রতীক হলো সে জাতির শিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষার  বিস্তার ঘটে শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বদানের ও সু নাগরিক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে, শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কথায় আছে - যে জাতি যত বেশী শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশী উন্নত। আর এর জন্য প্রয়োজন গুণগতমান শিক্ষা।  

বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে বলা হয় শিক্ষার মূল স্তম্ভ। একটি  জাতির আশা আকাঙ্খা, শিল্প সংস্কৃতি, চিন্তা চেতনা সব কিছু গড়ে উঠে গুনগতমান  মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। জাতির এই আশা আকাঙ্খা প্রতিপলন বাস্তবায়নের যে অগ্রনী ভূমিকা পালন করে থাকেন  তিনি হলেন একজন শিক্ষক এবং কর্মক্ষেত্রে হয়ে উঠেন একজন দক্ষ প্রশাসক।

দেশ গড়ার মহান কারিগর বা নিরস্ত্র হাতিয়ার। শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য কেবল শিক্ষাক্রম পরিমার্জন যেমন নয় এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষাক্রমের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন ও যোগ্য শিক্ষক ও উপযুক্ত লোককে যথাযথে স্থান দেয়া।নিরপেক্ষভাবে বিধি অনুযায়ী নূন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিগণকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা। প্রতিষ্ঠান প্রধানকে বলা হয় প্রতিষ্ঠানের প্রাণ। প্রতিষ্ঠান প্রধান নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনরূপ অনিয়ম কাম্য নয়।

আদর্শবান, শিক্ষাকতা কাজে উৎসাহী, সৃজনশীলতা, দক্ষতা, কর্মেস্পৃহা, পরিমার্জিত, সুষ্ঠু সবল,জ্ঞানের উৎকর্ষতাসাধন ব্যক্তিদেরকে প্রতিষ্ঠান প্রধানের গুরুদায়িত্ব দেয়া।  শিক্ষার গুনগত মানের জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। অনেক ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটেছে যা ছিল চোখে পড়ার মতো।

সরকারি নিয়মনীতি কাগজে কলমে। দলীয়পরিচয় ও হলুদ খামের আধিপত্য বিস্তার নিত্যনতুন ব্যাপার।  ফলে জাতি পেয়েছে  ভুরি ভুরি  জিপিএ...!

ফেক্টরীর কর্মী  পাওয়া গেছে, ফেক্টরি চালানোর মতো দক্ষ কর্মী  গড়ে উঠেনি। মানসম্মত শিক্ষা ছিল লেজে গোবরে। বিগত কয়েকবছর এসএসসি পাশের হার ছিল গড়ে ৮০%-৯০% এর মতো। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে মফস্বলেও ১০০% পাশের হার দেখা গেছে। অসুস্থ এক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল কার প্রতিষ্ঠান, কত বেশী % পারসেন্টেইজ দেখাতে পারে। ঘোড়া গাধা সবাই ফরম ফিলাপ করতে পারতো। ক্ষেত্র বিশেষে সব বিষয়ে  টেষ্টে ফেল করা ছাত্ররাও পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেওয়া হতো। ফলে কলেজগুলোতে এই ফেল করা ছাত্ররা অপরাজনীতি করার সুযোগ পেত।

টেন্ডারবাজী, চাঁদাবাজী, অপহরণ, ধর্ষণের মতো জগণ্য কাজে অপকর্মে জড়িত ছিল।  উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সবসময়, নিয়োগ বানিজ্য, হল দখল,  হানাহানি খুনখারাপি নিত্য নতুন এক কর্মযজ্ঞ । প্রাথমিক, মাধ্যমিক  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয়করণের মাধ্যমে কোচিং বানিজ্য ছিল  দেখার  মতো  ।

সরকারিভাবে শুক্রবার, শনিবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও বিশেষ সুবিধার জন্য শনিবারেও কোচিং পরিচালনা করা হতো ।  শুধু তাই নয় পাবলিক পরীক্ষা তথা এসএসসি পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে সকাল বেলা পরীক্ষা থাকলেও বিকাল বেলা ক্লাস পরিচালনার নামে নেয়া হতো বাড়তি আর্থিক সুবিধা। যদিও ২০০৫ সাল থেকে শিক্ষার গুনগতমান রক্ষার্থে সরকার এমপিওভুক্ত  মাধ্যমিক, কলেজ,মাদ্রাসাতে এন্ট্রি লেবেলের পদ সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে এনটিআরসিএর মাধ্যমে। এমপিওভুক্ত  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন মানসম্মত শিক্ষক থাকলেও নাই কোনো মানসম্মত বেতন, নেই কোনো পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা, শিক্ষকেরা ন্যায্য অধিকারের জন্য মাঝে মাঝে রাজপথে নামতেও বাধ্য হয়েছে। কর্মবিরতির মতো কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। ২০১৮ সালে এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীকে  সামাজিক নিরাপত্তার স্বার্থে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৫% ইনক্রিমেন্ট প্রদান করলেও ৪% কেটে নেওয়া হয়েছে। ফলে যে লাউ সে কদু। এনটিআরসিএ মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ হলেও  মানসম্মত বেতনভাতা না থাকার কারনে সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা কর্মস্থলে যোগদান করতে অনীহা লক্ষ্য করা গেছে। ৩% সরকারি হাই স্কুলের এন্ট্রি লেবেলের পদ সহকারী শিক্ষক ১০ম গ্রেড প্রাপ্ত হয়ে   বেতনভাতা পেয়ে থাকেন। অন্যদিকে ৯৭% এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এন্ট্রি লেবেলের একজন সহকারী শিক্ষক ১১তম গ্রেড প্রাপ্ত হয়ে তারমধ্য বাড়ীভাড়া ও মেডিকেল  হাস্যকর দিয়ে  বেতন-ভাতা  পেয়ে থাকেন।  একই শিক্ষাগত যোগ্যতা, একই সিলেবাস, একই কর্ম ঘন্টা, একই কারিকুলাম থাকা সত্বেও  এমপিওভুক্ত  শিক্ষকদের সুযোগ সুবিধার নিল্জ্জ চিত্র ফুটে উঠছে। সরকারি স্কুলের সহকারী শিক্ষকের কর্মজীবনের ৭ বছর অতিক্রম করার পর ৯ম গ্রেড প্রাপ্ত হন অপর দিকে এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষকেরা  কর্মজীবনে ১০ বছর অতিক্রম করার পর ১০ম গ্রেড প্রাপ্ত হন। এখনেও বিশাল একটা বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। শুধু তাই নয়, এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকেরা এখনো ৭ম গ্রেড হিসেবে বক্ল গ্রেডে আবদ্ধ রয়ে গেছেন এবং সরকারি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের মতো কাম্য যোগ্যতা থাকার পরেও তারা ৭ম গ্রেড নিয়ে চাকুরী থেকে অবসরে যেতে বাধ্য হন৷ এখনো প্রধান শিক্ষকদেরকে  ৬ষ্ট গ্রেডে উন্নত করা হয়নি যা অনেক কে, হতাশাগ্রস্ত করে।  

এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় অনেক সহকারী শিক্ষক আছেন যারা সহকারী প্রধান শিক্ষকের সমপরিমাণ বেতনভাতা ভোগ করে থাকেন। ফলে সহকারী প্রধান শিক্ষকেরা বেতনভাতা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ। অথচ সহকারী প্রধান শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবী ৮ম গ্রেড থেকে ৭ম গ্রেডে আপগ্রেড করা। যা কর্মক্ষেত্রে কাজের গতিশীলতা উদ্দীপনা জোগাবে বিশ্লেষকদের মতে ।  বিএনপি দেয়া ২৫% উৎসবভাতা নিয়ে টানা ১৭ বছর কাটাতে হয়েছে। হাজার কোটি টাকার বাজেটেও বিগত ১৭ বছর আর্থিক সংশ্লেষনের অজুহাতে এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের ঠকানো হয়েছে।

এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা পাওয়া দরকার, দিচ্ছি, দিব, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জীবনমানের তেমন পরিবর্তন হয়নি। বছরে বড়ো দুইটি  ধর্মীয় উৎসব থাকলেও এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের কাটাতে হয়েছে অসহায়ত্বের মতো। যদিও অন্তরবর্তী সরকার বিশেষ বরাদ্দ মাধ্যমে ২৫% বোনাস বৃদ্ধি করে নিজের দায়বদ্ধতা সরতে চেষ্টা করে করেছেন। শিক্ষকেরা নিরাপদ জীবনমান রক্ষায় নির্ধারিত দায়িত্বের পাশাপাশি প্রাইভেট টিউশনিতে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত উর্ধ্বগতি শিক্ষকের জীবনমান রক্ষায় সরকারকে বার বার তাগাদা দিলেও বিগত সময়ে দিচ্ছি, দিব, শিক্ষকদের দেওয়া দরকার, শিক্ষাবান্ধব সরকার, গবেষণার বিষয়,    এইগুলো সময় ক্ষেপন করার অপকৌশল। স্বাধীননতার ৫৪ বছর পেরুলেও  মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্হা এখনো অবৈতনিক হয়ে উঠেনি।  যা জাতির জন্য লজ্জাও বটে।

একটা সময় ছিল পাবলিক পরীক্ষার কেন্দ্রগুলোতে ১৪৪ দ্বারা জারি, মাইকিং করে সর্তক করা হতো অভিভাবকসহ  আমাদের প্রিয় ছাত্র ছাত্রীদের কে। যদিও এখনো এই আইন বলবৎ থাকলেও আগের মতো নেই সেই সতর্কবার্তা। এইচএসসির মতো কয়েকটি কেন্দ্রে সর্তক হিসেবে ব্যানার টাঙ্গানো সেই রীতি এখনো রয়েছে বা দেখা যায়। গেল বছরগুলোতে  অনেক নেতা কর্মীকে দেখা গেছে ভাইয়ের রাজনীতিতে জড়িত থাকতে, সেই রীতি এখনো বজায় থাকতে দেখা যাচ্ছে ।  

এখন পাবলিক পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে আমাদের ছাত্ররা দোকানপাটে আড্ডায় মেতে উঠে। নেই আগের মতো মাগরিবের নামাজের পর পরেই পড়ার টেবিলে বসতে।  মোবাইলে আসক্তের প্রবনতা অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে।প্রতিটি বাড়ীতে বা পাড়া মহল্লায় রাস্তার পাশে কিংবা ঝুপড়িতে বসে মোবাইল দেখার নেশাক্তে দেখা দিয়েছে। পরীক্ষার দিনের রাতেও আমাদের ছাত্ররা উচ্চস্বরে বলে বেড়াতো এত কথা কি দরকার অমুক ভাই চমৎকার !  

আমাদের মাধ্যমিক লেভেলের ছাত্ররাও এখন ভাইয়ের রাজনীতি শিখে গেছে ।  কেননা অপরাজনীতিতে টাকা কামানোর কমতি থাকে না। খুব অল্প সময়ে টাকার মালিক হওয়া যায়। কি দরকার এত পড়ালেখা করার! ভালো মানের পড়ালেখা করলেও ভাইয়ের সুপারিশে এবং ভাইকে হলুদ খাম  দিয়ে বা ভাইয়ের পিছনে না ঘুরলে চাকুরী পেতে বা অবৈধভাবে কিছু করতে গেলে কষ্ট পেতে হবে না ।

বিদ্যালয় চলাকালীন সময়ে প্রথম পিরিয়ডে ছাত্রদের উপস্থিতি ভালো থাকলেও দ্বিতীয় পিরিয়ডে ছাত্রদের উপস্থিতি তেমন থাকতো না। যদিও সেই অনুপস্থিতির হার এখনো রয়ে গেছে।

বিরতির পর ক্লাসগুলোতে ছাত্র ছাত্রীদের উপস্থিতির হার এখনো সন্তোষজনক নয় এর জন্য প্রয়োজন অভিভাবক, শিক্ষক ও ছাত্র ছাত্রীর সম্মেলিত প্রচেষ্টা।

গত কয়েক বছর আমরা দেখেছি পাবলিক পরীক্ষা তথা এসএসসিতে পাশের হার আকাশচুম্বী হলেও এইচএসসি পাশের পর উচ্চ শিক্ষার জন্য যখন ভর্তি পরীক্ষা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এই শতভাগ পাশের হার নামিয়ে আসে ৫%-১০% এ। ঢাবি,চবি, কুবি তথা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই দৃশ্য দেখা যেত গেল কয়েকবছর।  শুধু তাই নয় বিভিন্ন চাকুরী তথা নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের মাধ্যমেও ।  

সরকারি বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান চাকুরীর নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে।  চাকরীর নিয়োগ পরীক্ষাগুলোতে যে মার্জিনএবেল নাম্বার পাওয়ার কথা তা আশারূপ না হওয়ায়  কর্তৃপক্ষ অনেক সময় নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ করে দিতো ফলে আমাদের  শিক্ষার গুণগতমান   ফুটে উঠতো।  জাতির জন্য এই এক অসংনীয় সংকেত। যা একটা জাতির গুনগতমান রক্ষার্থে মোটেই সমীচীন নয়। ধন্যবাদ। 

তাং ০৬/০৯/২০২৫

=

লেখক : কাজী আনোয়ার হোসেন ; বিএ,বিএড, ডিপ্লোমা, এমএসএস (রাষ্ট্র বিজ্ঞান) জেলা সহ সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ও সভাপতি, সহকারী শিক্ষক পরিষদ,সন্দ্বীপ।