অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘সরকারকে নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা করা হচ্ছে না। গ্লাসের অর্ধেক পানি না দেখে গ্লাসের খালি অংশ নিয়েই সমালোচনা করা হয়। ভালো আলোচনাটাও আমরা শুনতে চাই। আমরা কিছু পদচিহ্ন রেখে যেতে চাই, যেটা পরবর্তী সরকার এগিয়ে নেবে। ’
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ; সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের লেখা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে সালেহউদ্দিন আহমেদ এসব কথা বলেন।
২০০৯ থেকে ২০২৫ সময়ে মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাগুলোর সংকলন এ বইয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, প্রশাসনসহ বিভিন্ন বিষয়ে ৪৩টি প্রবন্ধ রয়েছে।
গত ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, রোববার বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) কার্যালয়ে এ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘অর্থনীতির মূল হচ্ছে রাজনীতি। আর রাজনীতি মানে শুধু ক্ষমতায় গেলাম, তা নয়। সামনে যাঁরা সরকারে আসবেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বুঝবেন। আমরা দেশের জন্য কাজ করার চেষ্টা করছি। কিছুই হচ্ছে না, তা নয়। অনেকে যেভাবে সমালোচনা করেন, তাতে আমরা অনেক সময় হতাশা অনুভব করি।’
মন্ত্রণালয়ের কাজ সামলে বই লিখে তা প্রকাশ করা, ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া ইত্যাদি কীভাবে করেন মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, ‘যেসব বিষয় নিয়ে আমরা কাজ করি, সেখানে রাজনৈতিক অর্থনীতির বীভৎস চিত্র থাকে।’ উদাহরণ হিসেবে তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ঘটনার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক অর্থনীতি স্বচ্ছ করতে না পারলে সংস্কার কাগুজে হয়ে যাবে। সংস্কারের বিষয়ে আগে থেকে একটি ঐকমত্য থাকা উচিত।
সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, সংস্কৃতি তাঁর বিষয়। তবে অর্থনীতি সংস্কৃতিতে প্রভাব ফেলে। মেয়েরা যখন পোশাক খাতে কাজ করা শুরু করলেন, তখন তা আলাদা বিষয় হয়ে উঠল। উপদেষ্টাদের মধ্যে মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান হচ্ছেন তারকা পারফরমার। তাই তাঁর লেখা বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তিনি এসেছেন।
পিপিআরসির চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, একাডেমিক বইয়ের বাইরে জনপরিসরে লেখাও গুরুত্বপূর্ণ। জনপরিসরে লেখা যে মানের দিক থেকে হালকা হয়, তা নয়। বইটিতে ‘উন্নয়নের পথে আমাদের উল্টো যাত্রা’ নামের একটি অধ্যায় রয়েছে উল্লেখ করে হোসেন জিল্লুর বলেন, ফাওজুল কবির খান উন্নয়ন বলতে উন্নয়নের বহুমাত্রিকতা বুঝিয়েছেন।
মাথাপিছু আয় দিয়ে অগ্রগতি বোঝানোর চেষ্টা করলে এতে অনেক ফাঁক থেকে যায় এবং বৈষম্যের গল্প অনুপস্থিত থেকে যায় বলে মন্তব্য করেন হোসেন জিল্লুর। তিনি বলেন, নির্বাচনের মাইলস্টোন অবশ্যই অর্জন করতে হবে। আর অতিক্রম করতে হবে বৈধ দুর্নীতির সিনড্রোম।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের অগ্রগতিতে বড় বাধা ব্যবসায় অতিরিক্ত খরচ। এ জন্য দায়ী কাঠামোগত সমস্যা। ব্যবসায়ীরা এসব সমস্যা সমাধানের জন্য যত না আগ্রহী, তার চেয়ে বেশি আগ্রহী সমস্যার কারণে নীতি সহায়তা পেতে। কাঠামোগত সমস্যার অনেক মূল্য দিতে হয়। আছে ডান হাত, বাঁ হাতের সমস্যা, যা পরে নীতি সহায়তা দিয়ে পূরণ করা হয়। আরও আছে অনর্থনৈতিক সমস্যা। বইয়ের লেখকের প্রতি জাহিদ হোসেনের প্রশ্ন, ‘অনর্থনৈতিক চর্চা কি বন্ধ করতে পেরেছেন, নাকি যোগ করেছেন?’
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ খুব বেশি বৈশ্বিক সহায়তা না পাওয়ার কারণ তুলে ধরেন ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং টেকসই উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা আইনুন নিশাত। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় যে তহবিল ব্যবহার হয়, সেগুলোর যথাযথ তদারকি নেই, মূল্যায়নও নেই। এসব করার জন্য সরকারের খুব একটা ইচ্ছাও নেই।
জাহিদ হোসেনের ‘অনর্থনৈতিক চর্চা কি বন্ধ করতে পেরেছেন’ প্রশ্নের জবাবে বইয়ের লেখক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, একদম বন্ধ করতে পারেননি। তবে কেনাকাটায় প্রতিযোগিতার অবস্থা তৈরি করেছেন।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি, রেলপথ ও সড়কে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হওয়ার কথা তুলে ধরে ফাওজুল কবির খান বলেন, প্রতিযোগিতাকে নির্বাসনে দেওয়া হয়েছিল। এ জন্য ব্যয় বেড়েছিল অনেক। আসলে চেয়ারগুলোর দোষ নেই। দোষ পদ্ধতির ও ব্যক্তির। এক বছরে জ্বালানি তেল আমদানিতেই প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার সাশ্রয় হয়েছে। পদ্মা সেতুর অপ্রয়োজনীয় সংযোগ সড়কের ব্যয় বন্ধ করা হয়েছে। এভাবে তিন মন্ত্রণালয়ে এক বছরে সাশ্রয় করা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা।
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যেসব উপদেষ্টা দায়িত্ব পালনে সফল হয়েছেন, ফাওজুল কবির খান তাঁদের মধ্যে অন্যতম। এর কারণ, সরকার পরিচালনা সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা রয়েছে। অনেকে এ ধরনের দায়িত্বে আসেন, কিন্তু তাঁদের অভিজ্ঞতা থাকে না। তখন আমলানির্ভর হয়ে অথবা আমলাদের দ্বারা পরিচালিত হন। এতে অনেক সময় ক্ষতি হয়ে যায়।
মতিউর রহমান বলেন, সামনে নির্বাচন। এ নির্বাচন হতেই হবে। নির্বাচনে কোনো ধরনের জটিলতা গুরুতর সংকটের কারণ হবে।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক এ কে এনামুল হক।
তথ্যসুত্র : প্রথম আলো