যেখানে সিনেমা মানেই এক ঝাঁক তারকা, চোখ ধাঁধানো সেট, কোটি টাকার বাজেট আর ভিজুয়াল ইফেক্টের ঝলক, সেখানে দাঁড়িয়ে এক অদ্ভুত অথচ প্রগাঢ় এক চুপচাপ প্রতিবাদ করে গেলেন একজন— অরিন্দম মুখার্জী, ডাকনাম বিংকু।
একটি মোবাইল ক্যামেরা, একটি বটগাছের ছায়া, আর একমাত্র চরিত্র— নিজেই। না, তিনি কোনও বড় ব্যানারের পরিচালক নন, কোনও জনপ্রিয় অভিনেতা নন। কিন্তু তাঁর কণ্ঠে ছিল এমন এক গল্প, যা আড়ালের গ্রাম থেকে উঠে এসেছিল এক গভীর আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে। যে গল্পে ছিলো নিজের মাটি, নিজের মানুষ, নিজের লড়াই, নিজের রবীন্দ্রনাথ, এমনকি নিজের শেক্সপিয়ার।
এই একক অভিনীত চলচ্চিত্রে বিংকু যখন নিজের গ্রাম, তার চায়ের দোকান, তার বটগাছ, তার চাচা-ফুফুদের গল্প বলেন— তখন তা কেবল স্মৃতিচারণ হয় না; হয়ে ওঠে প্রতিরোধ। এ প্রতিরোধ সেই জাঁকজমকের বিরুদ্ধে, যাকে সিনেমার একমাত্র মানদণ্ড হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হয়।
এই চলচ্চিত্রটি যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়— রবীন্দ্রনাথও কিন্তু একা হাতে কালি-কলম তুলে নিয়েছিলেন, জোড়াসাঁকোর ঘরে বসেই। শেক্সপিয়ারও তো গ্লোব থিয়েটারের মাটির উপর দাঁড়িয়ে নাট্যকার হিসেবে নিজেকে রচনা করেছিলেন। তাহলে সিনেমার জন্য বহুব্যয়ী সেট, তামাম প্রযোজক, আর চমকপ্রদ সংলাপের কী দরকার, যদি একটিমাত্র চোখ, একটি মুখ, আর একটি হৃদয় থাকে বলবার মতো?
অরিন্দম মুখার্জীর এই ‘একক চরিত্রের সিনেমা’— আসলে এক বিপরীতগামী সাহস। সেটা প্রযুক্তির নয়, চিন্তার। এ যেন সিনেমার উৎসে ফেরা। যখন ক্যামেরা ছিল না, কিন্তু গল্প ছিল, মুখ ছিল, আর ছিল এক চিলতে আলো।
আমরা আশা করি এই ধরনের প্রয়াস আরও এগিয়ে আসবে। কারণ সিনেমা মানে শুধু বিনোদন নয়— সিনেমা মানে আত্মচিন্তার ভেতর দিয়ে সমাজকে প্রশ্ন করা। বিশ্বের কিছু নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্রে একক অভিনয় দেখা গেলেও, বাংলাদেশে মঞ্চে v প্রয়োগের নজির থাকলেও— ফিল্ম মাধ্যমেই এই প্রথম একজন শিল্পী সম্পূর্ণ একক অভিনয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য ক্যানভাস তৈরি করলেন। অরিন্দম সেই প্রশ্নটা ছুঁড়েছেন আমাদের দিকে— “সিনেমা কার জন্য?"
আমরা কি প্রস্তুত উত্তর দিতে?
# শিশির চৌধুরী ।। লেখক ও সাংস্কৃতিক কর্মী