মেঘলা বিকেল। বেলকুনির এক কোণে কাঠের দোলনাটি ঝিমিয়ে আছে, আর তার পাশে বসে আছেন হাশেম সাহেব। চোখের চশমাটা একবার পরেন, আবার খুলে ফেলেন। মাজেদা বেগম বেলকুনির রেইলিং ধরে দাঁড়িয়ে দূরের গলিটা দেখেন,সেই পুরোনো গলি, যে গলি দিয়ে ছোট্ট মিশু স্কুলের ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে ছুটে যেত, ফিরে আসত দৌড়ে, আম্মু, আম্মু, শুনো তো আজ স্কুলে কী হয়েছে!’
কোথায় গেল সেই দিনগুলো?
মিশু বড় হতে হতে যখন কলেজে উঠলো, তখনও মা-বাবার চোখে সে সেই ছোট্ট ছেলে। ওর প্রিয় খাবার রান্না হতো, বাবা অফিস থেকে ফেরার পথে লুকিয়ে পছন্দের চিপস-চকলেট কিনে আনতেন,যেন মিশুর মুখে একটুখানি হাসি ফোটে!
কিন্তু বয়সের সাথে সাথে মিশুর হাসি পাল্টাতে লাগল। অচেনা বন্ধুরা, রাত করে ফেরা, দরজার ছিটকিনি খুলে ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে কড়া গন্ধ,হাশেম সাহেব কিছুটা বুঝতে পারতেন।
একদিন রাতে হালকা গলায় বলেছিলেন,বাবা, এমন করে বাইরে থাকতে নেই, পড়াশোনার ক্ষতি হয়। ’
মিশু ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল,আপনারা সবসময় সন্দেহ করেন! আমি ছোট নেই! আমার স্বাধীনতা আছে!’
মাজেদা বেগম কাছে গিয়েছিলেন,বাবা, তোর জন্যই তো বলি, তুই তো আমাদের প্রাণ!’
মিশু উল্টো বলেছিল—‘প্রাণ? শাসন আর নজরদারি করাই আপনাদের কাজ! একটুও বিশ্বাস করেন না!’
সেই রাতেই প্রথম বার হাশেম সাহেব বুঝেছিলেন, এই সন্তান আর সেই ছোট্ট মিশু নেই।
তারপর একদিন সকালবেলা, দরজার বেল বেজে উঠল। দুজন পুলিশ।
‘আপনারা ছেলেকে মানসিক চাপে রাখছেন, সে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে,এমন অভিযোগ উঠেছে।’
হাশেম সাহেব গলার স্বর হারিয়ে ফেলেছিলেন। মাজেদা বেগম কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছিলেন বাবা! তুই এমন করলি?’
মিশু মাথা নিচু করে ছিল, তবু মুখে শক্ত কথা আমার স্বাধীনতা দরকার।’
সেদিন ওদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কৌতূহলী মানুষ ফিসফিস করেছিল,ছেলেকে কী এমন অত্যাচার করেছে বাবা-মা?’
কেউ জানে না, সেই ‘অত্যাচার’ মানে একটু সাবধান বাণী, একটু শাসন, যে শাসনেই ছিল ওদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, সীমাহীন ত্যাগ!
মিশু বাসা ছেড়ে চলে গেছে। আর কোনো খবর নেই। ফোন নম্বরও বন্ধ। মাঝে মাঝে ফেসবুকে ছবি দেখা যায় বন্ধুদের সাথে হেসে, পার্টি করছে। অথচ বাবা-মায়ের ফোনে কোনো মেসেজ আসে না।
মাঝে মাঝে মাজেদা বেগম ভোর রাতে উঠে পড়েন। ছেলের খালি খাটে হাত রাখেন। শূন্য বালিশে মুখ গুঁজে নিঃশব্দে কাঁদেন, কী দোষ ছিল রে বাবা, তোর ভালো চাইতে গিয়েই তোর কাছে শত্রু হলাম!’
হাশেম সাহেব একদিন লুকিয়ে ছেলের ছেলেবেলার ডায়েরিটা বের করেছিলেন,আমার আব্বু আমার হিরো। আমার আম্মু রান্না করতে পারে পৃথিবীর সেরা খিচুড়ি।’
তিনি ডায়েরিটা বুকে চেপে রেখে ফিসফিস করে বলেছিলেন,তুই হারিয়ে গেলি কেন রে বাবা! আমাদের এত বড় শাস্তি দিবি!’
দুজনেই আবার অপেক্ষা করেন সেই পুরোনো গলির দিকে চেয়ে থাকেন, যদি হঠাৎ একদিন মিশু ফিরে আসে।
হয়তো বলে,আম্মু আজ না ওদের সাথে ঝগড়া হয়ে গেছে, তুমি খিচুড়ি রান্না করে দাও।’
হয়তো বলে,আব্বু, আমাকে বকা দাও, আবার শাসন করো, আগের মতো।’
কিন্তু সে আশা দিন দিন মরে যাচ্ছে। শুধু থেকে যাচ্ছে নিঃশ্বাসে জমে থাকা দুঃখ, অশ্রু আর একটা প্রশ্ন,সন্তান ভালো থাকুক এই আশাতেই কি সব বাবা-মা শাসনের অপরাধী হয়?’
সম্প্রতি ঢাকার এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্রী তার বাবামায়ের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছে তার নিরাপত্তাহীনতার অভিযোগ তুলে। সেই প্রেক্ষাপটে আমার এই কাল্পনিক গল্প।
✍️এস এম জাকিরুল আলম মেহেদী।
লেখক, (১) সন্দীপন) (২) স্মৃতিপুঞ্জ(৩)সন্দ্বীপের শিকড়ে।
১৪/৭/২০২৫.