আজ মঙ্গলবার, ০১ জুলাই, ২০২৫ || ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ মঙ্গলবার, ০৯:৪৬ অপরাহ্ন
মঙ্গলবার, ০১ জুলাই, ২০২৫   |   sonalisandwip.com
একজন ডিআইজি কাজী জিয়াউদ্দিন : মেধা ও সততার মূর্ত প্রতীক এক ব্যতিক্রমী পুলিশ কর্মকর্তা

রফিকুল হায়দার 

▪️▪️▪️▪️▪️

বাংলাদেশের সরকারি ব্যবস্থাপনায় কিছু কিছু দপ্তরের নাম উচ্চারণ করলেই সাধারণ মানুষের মনে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অতিরিক্ত অর্থের গল্প ভেসে আসে। এ তালিকায় যেগুলোর নাম প্রথম দিকে থাকে, তার মধ্যে নিঃসন্দেহে রয়েছে পুলিশ বিভাগ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, পুলিশ বিভাগের নীচু স্তর থেকেই উচ্চপর্যন্ত অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অপ্রদর্শিত সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেও কিছু মানুষ আছেন, যারা স্রোতের বিপরীতে হেঁটে প্রমাণ করেছেন ‘সততা এখনো বিলুপ্ত হয়নি’।

এমনই এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব হলেন পুলিশ হেডকোয়ার্টারে কর্মরত ডিআইজি কাজী জিয়াউদ্দিন। আমাদের দেশে যেখানে ডিআইজি পর্যায়ের একজন পুলিশ কর্মকর্তার সম্পদের পরিমাণ অনায়াসেই শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে, সেখানে এই মানুষটির জীবনযাপন আক্ষরিক অর্থেই সাধারণ একজন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর মতোই সাদামাটা, অনাড়ম্বর।

তাঁকে আমি জানি সপ্তম/অষ্টম শ্রেণির ছাত্রাবস্থা থেকে। চট্টগ্রাম কলেজের সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক কাজী গিয়াস উদ্দিন স্যারের ছেলে। ছাত্র অবস্থায়ই তিনি যেমন মেধাবী ছিলেন, তেমনই ছিলেন নীতিবান ও চরিত্রবান। পুলিশের চাকরিতে ঢুকার পর থেকে ২৫ বছর কোনো যোগাযোগ না থাকলেও তাঁর সংগ্রাম করে সততা ও নৈতিকতার উপর টিকে থাকার তথ্য আমাদের কাছে ঠিকই ছিল।

জনৈক বিপদগ্রস্ত এক সহযোগিতা প্রার্থী অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন এভাবে- "ব্যক্তিগত এক প্রয়োজনের কারণে তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। পরিচয়ের সূত্রে নয়, শুধুমাত্র একজন নাগরিক হিসেবে তাঁর সাহায্য চাই। আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনার পর তিনি কোনো রকম কৌশল বা গড়িমসি না করে, আমার বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করে কাজটি নিষ্পন্ন করে দেন, যাতে আমার এক কানাকড়িও লাগেনি। অথচ ঠিক একই কাজ আমার পরিচিত কয়েকজনকে বিপুল অর্থ ব্যয়ে অন্যদের মাধ্যমে করতে হয়েছে। তখনই আমার মনে এই কর্মকর্তার একটি পবিত্র ভাবমূর্তির ছাপ বসে যায় এমন “এই মানুষটি অন্যদের চেয়ে আলাদা।"

পরবর্তীতে খোঁজ খবর নিয়ে যা জানলাম, যা আমাকে সত্যিই আনন্দিত করে। কাজী জিয়াউদ্দিন শুধু একজন সৎ কর্মকর্তা নন, তিনি একজন মেধাবী, সাহসী এবং নীতিবান ব্যক্তিত্ব। পুলিশ বিভাগে যারা মেধা, দায়িত্ববোধ ও নৈতিকতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হন, তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। পুলিশের প্রতিনিধি হয়ে কথা বলতে তাকে কয়েকবার জাতীয় টেলিভিশনের টকশোতে দেখা গেছে এমনকি তিনি শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নন, আন্তর্জাতিক পরিসরেও পুলিশের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। তিনি পুলিশের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, বিদেশি মিশন ও কূটনৈতিক ব্রিফিং প্রস্তুত করেন, এবং মুখপাত্র হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর নিষ্ঠা, সততা ও প্রজ্ঞার কারণে তিনি হয়ে উঠেছেন পুলিশের সর্বোচ্চ স্তরে আস্থার প্রতীক।

চাকুরী জীবনের বিভিন্ন সময়ে পুলিশ বাহিনীর সবচেয়ে লোভনীয় পোস্টিংগুলো তাঁর নাগালের মধ্যে থাকলেও তিনি সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। থেকেছেন পুলিশের বুদ্ধিভিত্তিক চিন্তাশীল ক্রিয়াকলাপ নিয়ে।

তাছাড়াও তাকে দিয়ে কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কিংবা অনৈতিক কাজ করানো যাবেনা বিধায় তাকে কখনো মাঠ পর্যায়ে যেমন জেলার এস পি, কিংবা বিভাগের ডিআইজি পদে পদায়ন করে পাঠানো হয়নি বলে আমি জানতে পারি। এতে সাধারন জনগন তার আন্তরিক সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও (আইজিপি) তাকে দীর্ঘ সময় সদর দপ্তরেই রেখেছেন কারণ স্বচ্ছতা, সততা, মেধা ও মননশীলতার কাজগুলো তাকে দিয়ে নিখুঁত ও স্বচ্ছন্দে করানো যায়। এভাবে যখন যিনিই পুলিশের শীর্ষ পদে এসেছেন তিনিই তাঁকে অন্য কোথাও যেতে দেননি।

একটি ঘটনা না বললে তৃপ্তি পাচ্ছি না, তাহলো- তাঁর এক শুভানুধ্যায়ী তার এক আত্মীয়ের সুবাদে এই মানুষটির সঙ্গে একদিন তাঁর বাসায় গিয়ে দেখা করার সুযোগ নেয়। শনিবার, সপ্তাহান্তের ছুটির দিন। বাসায় যাওয়ার আগে আত্মীয়কে বলে, কিছু মিষ্টি নিয়ে যাই। আত্মীয় সোজা নিষেধ করেন “কাজী সাহেবের বাসায় কোনো কিছু নিয়ে গেলে সেটা সহ আপনি গেট থেকেই পত্রপাঠ বিদায় হবেন।” অবশেষে খালি হাতেই যেতে হয়, আর মন ভরে কথা বলে। তাঁর ব্যবহার, চিন্তাভাবনা ও জীবনবোধ এমনভাবে তাকে মুগ্ধ করে যে, সে গল্প বাহিরে অন্যদের না বলে পারে না।

অথচ বিশ্বাস করা কঠিন, এই পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা, যার দেশের গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা সিদ্ধান্তে ভূমিকা রয়েছে। তার নিজের নামে নেই কোনো জমি, কোনো ফ্ল্যাট, নেই ব্যাংক ব্যালান্সে, সঞ্চয়ের পাহাড়। মাস শেষে বেতন ফুরিয়ে যায়, দুই মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাতে হয় হিসেব করে। অবসরের পর হয়তো তাঁকে অন্য চাকরির খোঁজ করতে হবে, পরিবার চালানোর জন্য।

সম্প্রতি কিছু ফেসবুক পোর্টালে তাঁর নামে অবমাননাকর ও আজগুবি গুজব ছড়ানো দেখে আর চুপ থাকতে পারলাম না। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, তাঁর সততা ও স্বচ্ছতার কারণে যারা অবৈধ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তারাই তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত। এই ধরনের মানহানিকর গুজব শুধু একজন সৎ কর্মকর্তাকে অপমানই নয়, বরং দেশের নৈতিক স্তম্ভগুলোকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে।

যারা নিজেরা সরকারি চাকরিতে থেকেও সততার দাবি করেন, তারা কি কখনও নিজেদের জিজ্ঞেস করেছেন?—"আমরা কি কখনও অনৈতিক সুযোগ পেয়েছিলাম, আর তাতে লোভ সংবরণ করতে পেরেছিলাম? নাকি সুযোগই পাইনি, তাই নিজেদের সৎ বলে দাবি করি?"

কাজী জিয়াউদ্দিন এমন একজন মানুষ, যিনি বারবার সুযোগ পেয়েও নৈতিকতার সাথে আপোষ করেননি। এটাই তাঁকে আলাদা করেছে, এটাই তাঁকে মহান করেছে।

আজকের বাংলাদেশে, যখন দুর্নীতি, সুবিধাবাদিতা আর আত্মস্বার্থে গড়া নীতিহীনতার রাজত্ব, তখন কাজী জিয়াউদ্দিনের মতো একজন অফিসার শুধু একজন ব্যক্তি নন, তিনি এক অনুপ্রেরণা। তিনি প্রমাণ করেছেন, মেধা, সততা আর নিষ্ঠা মিলেই গড়ে ওঠে একজন প্রকৃত জনসেবক।

এই জাতির উন্নতির জন্য, পুলিশের ভাবমূর্তি উদ্ধারের জন্য, এমন হাজারো কাজী জিয়াউদ্দিনের প্রয়োজন। আর আমাদের দায়িত্ব, এই ধরনের মানুষগুলোকে শ্রদ্ধা করা, তাঁদের পাশে দাঁড়ানো এবং অপপ্রচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো।

▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️

রফিকুল হায়দার ; সাবেক ব্যাবস্থাপক,ইস্টার্ন রিফাইনারি