সন্দ্বীপ থেকে ফিরে.. এস এম জাকিরুল আলম মেহেদী
ভোরের হিমেল বাতাসে যখন আমার চোখ মেলে, তখনও কানে ভাসে দিঘির ঘাটে জলের ছলাৎ শব্দ যেন শতাব্দী পেরিয়ে আসা কোনো শোকগাথা। শানবাঁধানো সেই ঘাটের ধারে কত ভোরে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম, পানি ছুঁয়ে দেখেছিলাম বালক হাতের স্বপ্ন।
সন্দ্বীপ টাউনের বুকজুড়ে তখনো ছিলো পর্তুগীজ বণিকদের টিনের আদালত, খাড়া ছাদের ঘর, আর দূর সমুদ্র থেকে ভেসে আসা নোঙরহীন নৌকার গুণগুণ। বৃষ্টি পড়লে রাস্তার ধার বেয়ে পানি নেমে যেত, দোকানিরা ছাতা মেলে দাঁড়িয়ে থাকতো, আর বালকের দল কাদামাটি গায়ে মেখে শহরের বুক চিরে ছুটে বেড়াতো।
সন্ধ্যা নামলে শহর জেগে উঠতো নতুন সুরে বিজলির আলোয় চায়ের দোকান, গলির মাথায় বাঁশের বারান্দায় যুবকের দল। কলাভবন থেকে ভেসে আসতো বাঁশির টান, আর Sakil Mahbub Khan দের উঠানে মেজ মামা হয়তো মাদুর পেতে বসে গল্প শোনাতো, লুপ্ত রাজাদের, পর্তুগীজ জলদস্যুদের, টেমসের মতো গড়া সেই খেয়াঘাটের।
কিন্তু সময়ের ঢেউ বড়ো নিষ্ঠুর। একে একে খয়েরি দেয়াল খসে পড়লো, আদালতের আঙিনা ঝড়ে উড়ে গেলো, শানবাঁধানো ঘাট ঢেকে গেলো পলিতে। যারা একসময় এই শহরের বুক জুড়ে শাসন করেছিলো, তাদের উত্তরসূরি আমি উদ্বাস্তু হয়ে ছুটে বেড়াই মরুর বুকে।
রাতের বালির ঝড়ে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করি, কানে আসে টুপ টুপ, দিঘির জলে জোয়ার আসছে বুঝি! চোখ খুললে দেখি চারপাশ শুধু বালি, না আছে দিঘি, না আছে আদালত, না আছে সেই শানবাঁধানো ঘাটের ডাক।
তবু মন মানে না, বুকের ভেতর এক টুকরো শহর আগলে রাখি ইটের দেয়াল, ছলাৎ জল, মাটির গন্ধ, হারিকেনের আলো, বাঁশির সুর। এই শহর আমার স্বপ্নের মধ্যে বাঁচে, বিষাদের মধ্যে বাঁচে, আমার শিরায় শিরায় বয়ে চলে সন্দ্বীপ টাউনের হারানো স্রোতধারা।
আমি জানি, কোনোদিন হয়তো ফিরে পাবো না সেই শহর, কিন্তু শহর তো আমাকে পেয়েছে আমার গল্পে, আমার দুঃখে, আমার অশ্রুজলে। আর তাই মরুর বুকের এই একাকী উদ্বাস্তু প্রতিদিন রাত হলে শুয়ে শুয়ে শোনে ঢেউয়ের দোলা, শানবাঁধানো ঘাটের ডাক।
সন্দ্বীপ টাউন হারিয়ে গেছে, কিন্তু আমাদের গল্পে সে চিরকাল বেঁচে থাকবে।
---------------------------------------------------------------------
✍️ এস এম জাকিরুল আলম মেহেদী । সন্দ্বীপের সন্তান।
কুয়েত প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক।